ইউক্রেইনে যুদ্ধ: আপনারা কে কে আমেরিকা, কে কে রাশিয়া?

যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেইন ও রাশিয়ার মধ্যে। আমরা প্রশ্ন করছি, আপনি কি রাশিয়া নাকি আমেরিকা? কেন এ প্রশ্ন করা হচ্ছে, সেটি ব্যাখ্যা করতে যাওয়াটা অবান্তর। প্রকান্তরে আমরা সবাই বুঝছি, এটি আসলে দুই পরাশক্তির লড়াই। কাজেই রাশিয়া না আমেরিকার দলে- এ প্রশ্ন নিয়ে সোশাল মিডিয়া সরব। দুই পক্ষেই অনেক সমর্থক আছে।

রাশিয়ার পক্ষে যারা সোশাল মিডিয়া কাঁপাচ্ছেন, তাদের কারও কারও সমাজতন্ত্রের সুখস্মৃতি ফিরে এসেছে। তারা কেউ কেউ কিয়েভের বোমা-বারুদের গন্ধকে প্রাভদা-রাদুগা-প্রগতি প্রকাশনী থেকে বের হওয়া রঙিন, পিচ্ছিল কাগজের দুর্দান্ত বইয়ের গন্ধের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। এরা লাতিনেও আছে, পুতিনেও আছে। লাতিনের কিউবায় বা চিলিতে, পুুতিনের সাবেক সোভিয়েতে।

পুতিনের পক্ষে আরো একদল আছেন এ দেশে। যারা ইহুদী-নাসারা বলে আমেরিকাকে ঘৃণা করে আসছে। যেকোনও মার্কিন ক্ষতি যাদের উল্লাসের সেরকম ধর্মীয় মৌলবাদী দলও আছে এখানে। এরা বিচার করে আফগানে বা ইরাকে মার্কিনিরা যা করেছে, সেটার একটা জবাব দিচ্ছে রাশিয়া। হয়তো রাশিয়ার পক্ষে এদেশের মৌলবাদী কিংবা ইসলামিস্টদের একটি দল খুব আগেই মাঠে নামতো, যদি না ‘কমিউনিজম’ এবং ‘নাস্তিকতা’র দায়ে সাবেক রাশিয়ার পিতৃপুরুষ সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের কুদৃষ্টিতে না থাকতো। এদের দৃষ্টিতে আমেরিকা খারাপ, কিন্তু রাশিয়া খারাপ ছিল- এখন ততোটা নয়, কেননা দেশটিতে এখন তো আর কমিউনিস্টরা নাই!

এখন যদি এ গোষ্ঠিকে বলা হয়, ভাই রাশিয়ার সেনারা কিন্তু ইউক্রেইনে থাকা তাতার মুসলিমদের নিধন করবে সবার আগে- এরা রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে নিবে বলেই মনে হয়। যদিও যুদ্ধ বাদে স্বাভাবিক অবস্থায় এরাই প্রশ্ন তুলতো- তাতাররা আসলে মুসলিমই কিনা!

আমেরিকার পক্ষে কারা আছে? অবশ্যই সবার আগে দেশের অন্যতম বড় বিরোধী দল বিএনপি ও তার কিছু সমর্থকদের অন্তত থাকার কথা। কেননা, তাদের এ দুর্দিনে কেবল আমেরিকাই একটু আহা-উহু করে গেছে। আর জামায়াতে ইসলামীরও থাকার কথা। র‌্যাববিরোধীদের থাকার কথা। সরকারবিরোধীদের থাকার কথা। প্যারাডক্স হচ্ছে, সরকারবিরোধীদের মধ্যে ইসলামিস্ট অংশটি বাদে, একটি বড় অংশ আবার কমিউনিস্ট রাজনীতির কথা বলে। কাজেই তারা পড়েছেন বিপাকে।

বাংলাদেশ সরকার কোন পক্ষে? আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে- সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কাজেই যুদ্ধরত দুই দেশই তাহলে সরকারের বন্ধু? সে কথা থাক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন- ‘জাতিসংঘ সনদে’র আলোকে তারা সমাধান চায়। জাতিসংঘ সনদের আলোকে সমাধান না হলে হয়তো বাংলাদেশ সরকার খুব ধীরে ধীরে সময় নিয়ে একটা পক্ষ বেছে নেবে বা চুপচাপ থাকবে। সরকার যে পক্ষ বেছে নেবে, বিরোধীরা আলবৎ তার বিপরীত পক্ষের গুণগাণ গাইবে।

ধরা যাক, সরকার বললো ‘আমরা মনে করি রাশিয়া ঠিক আছে’, বিরোধীপক্ষ অবশ্যই বলবে- ‘রাশিয়া এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি বর্বরতা চালিয়েছে’।

আবার পরিস্থিতি যদি এমন হয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেটোভুক্ত দেশগুলো এক হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো- রাশিয়ার পক্ষে দাঁড়ালো চীন ও উত্তর কোরিয়া, তখন বাংলাদেশ কী করবে? কিংবা ধরা যাক রাশিয়ার পক্ষে দাঁড়ালো বাংলাদেশের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত, তখন? ভারত যে রাশিয়ার পক্ষে থাকতে রাজি সরাসরি সেটি না বললেও, যুদ্ধ লাগার আগে থেকেই তাদের কূটনীতিকদের নিম নিম কথাতে কিছুটা প্রতিভাত হয়েছে।

ধুর পরিস্থিতি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কোন পক্ষে যাবে? এখানকার মানুষের কোন পক্ষে যাওয়া উচিত?

এক্ষেত্রে অবশ্যই একটা হিসেব সামনে চলে আসবে। বাংলাদেশের সঙ্গে কার কতোটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে সেটি একটি বিবেচনায় আসবে। অর্থাৎ ‘ডিজিট’ দেখে বন্ধু বা পক্ষ নির্ধারণের পথে হয়তো আগাবে সরকার। সাথে পুরনো বন্ধুত্বের ঐতিহ্যের ব্যাপারটি মাথায় থাকবে। এখানে পুরনো বন্ধুত্ব অনেকটা দোকানের পুরনো কাস্টমারের মতো, যার লেনদেন হয়তো কম- কিন্তু অনেকদিন ধরে যিনি কেনাকাটা করেন।

এখন প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। যেমন- বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের চেয়ে কম। তখন কী হবে?

এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুবিধায় একটি পরিসংখ্যান দেই। যেমন- ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি ছিল ৬৮ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, রাশিয়াতে ৬৮ কোটি ৬ লাখ ডলার এবং ভারতে ১২৭ কোটি ডলার। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০০ কোটি ডলার।

এবার ইউক্রেইন যুদ্ধে এসব দেশের মধ্যে কোন্‌ কোন্‌ দেশ কোন্‌ পক্ষে জড়িত হচ্ছে, তাদের সঙ্গে রপ্তানির যোগফল মিলিয়ে একটা পক্ষ নিয়ে নেওয়া যায়। এটা হয়তো খুব সরল হিসাব। কিন্তু যুদ্ধে পক্ষ নেওয়ার হিসাব ঠিক এভাবেই হয়।

রাশিয়া কিংবা আমেরিকার পক্ষে নেই, এমন দলও আমাদের দেশে রয়েছেন। এরা যুদ্ধ চান না, শান্তি চান। এরা যুদ্ধের নামে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে চান। সোশাল মিডিয়ায় এ ধরনের মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব এসব মানুষের কণ্ঠস্বর। প্রশ্ন হলো- যুদ্ধের ময়দানে, নিরপেক্ষ থাকার কোনও উপায় আছে? যুদ্ধবাজ বড় দেশগুলোর মোড়লিপনা মেনে নিয়ে, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ নীতিতে এগিয়ে চলার কোনও সুযোগ আছে? কোনও না কোনও পক্ষকে তো শত্রু বানাতেই হয়। কিংবা আপনি বানাতে না চাইলেও কেউ না কেউ শত্রু হয়েই যায়।

যুদ্ধ- বিশেষ করে যেখানে সাধারণ মানুষও জড়িয়ে পড়ে সংঘাতে-হত্যায়, যা তাদেরকে আর কখনো পুরনো জীবনে ফিরে যেতে দেয় না, সেখানে কোনও না কোনও পক্ষ নেওয়া লাগে। যুদ্ধ মানে সংখ্যা। যুদ্ধ মানে বোমা-গুলি, হত্যা, আহত, ধর্ষণসহ মানুষের কদর্য রূপের সংখ্যা। এই সংখ্যা উপেক্ষা করা যায় না। এই সংখ্যার পক্ষে-বিপক্ষে না থাকতে চাইলেও, থাকতে হয়। আমরা যে পরবর্তীতে হিসাব করি কোন্‌ যুদ্ধ কতোটা ভয়াবহ ছিল, তা কিন্তু প্রাণহানির সংখ্যার বিচারেই। যুদ্ধে যা ক্ষতি হয়েছে তার বিপরীতে যুদ্ধপরবর্তী বাণিজ্য ও লেনদেন মিলিয়েই তুলনা হয় আমাদের পক্ষ কোন্‌টা হবে। তাই যারা নিরপেক্ষ, হত্যা রক্তপাতের ঘোরবিরোধী- তারাও কোনও না কোনও সময়, পক্ষে-বিপক্ষে চলে যায়। মনে মনে একটি পক্ষকে দোষারোপ করে।

আমাদের প্রকৃতি হলো, নিজেরা আক্রান্ত না হলে- আমরা উত্তেজনায় থাকি। মনের ভেতরে সবসময় একটা দ্বন্দ্ব চলে- যুদ্ধ হোক, আবার ভাবি- না হোক। এই সমস্ত দ্বন্দ্বের পরও সিরীয় শিশু আইলানের সৈকতের বালুতে উপর হয়ে পড়ে থাকা লাশ, আমাদের চোখ ঝাপসা করে দেয়। আমাদের মাথার ভেতর কন্যার কাছ থেকে বাবার বিদায় নেওয়ার ছবি একটি দু:খের ছাপ ফেলে যায়। আমরা ঘুমের মধ্যে দু:স্বপ্ন দেখি হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমায় ঝলসে যাওয়া সেই শিশুটিকে। আমরা একটু একটু করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণা পুষে রাখি।

সংখ্যার কাছে, পুঁজির কাছে, বাজারের কাছে, মুক্তির স্বপ্ন বারবার হেরে যায় যুদ্ধে। তবুও মানুষ হয়তো যুদ্ধ ভুলে যাবে একদিন- এ কথা ভেবে প্রতিবাদের চর্চা চলুক। প্রতিবাদের চর্চাই যুদ্ধহীন পৃথিবী গড়ে তুলবে একদিন।

About Sazzamul Ahmed

Check Also

The Road Was Repaired by Rajib, The MP’s Son

Tanjir Ahmed Rajib, a member of the Central Volunteer League, has taken initiative to repair …